পাকিস্তানে ইমরানের বিদায়ঘণ্টা কারা বাজিয়েছে?

 অনলাইন ডেস্ক    ১৬ অক্টোবার, ২০২৩ ১৫:০৮:০০নিউজটি দেখা হয়েছে মোট 18 বার

ইমরান খান যারা ক্রিকেট বা রাজনীতি পছন্দ করেন তাদের কাছে তার নামটি অচেনা নয়। তিনি যেমন ক্রিকেটে পাকিস্তানকে বিশ্বকাপ জিতিয়ে বিশ্বের ক্রিকেট প্রেমীদের মনে জাইগা করে নিয়েছিলেন, তেমনি রাজনীতিতে হয়েছিলেন জনপ্রিয় নেতা।

ইমরান খানকে পাকিস্তানের একজন জনপ্রিয় রাজনীতিবিদ বললে তা বাড়িয়ে বলা হবে না। কারণ, তিনি ছিলেন পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) এর চেয়ারম্যান।

তিনি যেমন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন তেমনি ক্ষমতাচ্যুতও হয়েছেন। আবারও সম্প্রতি গ্রেপ্তার হয়ে এসেছেন আলোচনায়।

ইমরান খান যখন তার শেষ ক্রিকেট বিশ্বকাপ খেলেছিলেন তখন সালটা ছিলো ১৯৯২। তখন ইমরান ছিলো পাকিস্তান ক্রিকেট টিমের অধিনায়ক। অধিনায়ক ইমরান খানের নেতৃত্বে সেই সময় ওয়ানডে বিশ্বকাপ জিতেছিল পাকিস্তান। ওই জয় দিয়েই ক্রিকেটের মাঠ ছেড়েছিলেন তিনি। এর চার বছর পর পা রাখেন রাজনীতির মাঠে।


তিনি ১৯৯৬ সালে শুরু করেন রাজনীতি। বিশ্বকাপ জেতার কারণে সেই সময় ইমরান খানের জনপ্রিয়তা ছিল তুঙ্গে। তবে তিনি সেই জনপ্রিয়তা নিয়ে রাজনীতির মাঠে নেমে যে খুব ভালো করতে পেরেছিলেন এমনটা নয়।

ইমরান খান রাজনীতির মাঠে নেমে শুরুতেই গঠন করেছিলেন একটি দল। দলটির নাম পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই)। রাজনীতিতে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠা এবং ক্ষমতাধর দল হয়ে উঠতে তাঁকে অপেক্ষা করতে হয়েছিলো দীর্ঘ ২৪ টি বছর। তবে এই অপেক্ষার পর তার দল ২০১৮ সালে এসে সরকার গঠনের সুযোগ পেয়েছিলো। তবে সেটি ছিলো জোট সরকার।


এখানে পাকিস্তানের পার্লামেন্ট ব্যবস্থাটা একটু ভিন্ন। তাই আমাদের এই বিষয়ে জেনে নেওয়া দরকার।

পাকিস্তানের পার্লামেন্ট দুই কক্ষ বিশিষ্ট। উচ্চকক্ষকে বলা হয় সিনেট। আর নিম্নকক্ষকে বলা হয় ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি। নিম্নকক্ষে সদস্যসংখ্যা ৩৪২। এর মধ্যে ২৭২ জন সরাসরি জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে থাকেন। আর ৬০টি আসন নারীদের জন্য সংরক্ষিত। আর ১০টি আসন সংরক্ষিত ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জন্য।

সিনেটে সদস্য থাকেন ১০৪ জন। সিনেট সদস্যরা আসলে সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হন না। তাঁদের নির্বাচিত করে থাকেন প্রভিন্সিয়াল অ্যাসেম্বলির সদস্যরা। এর মধ্যেও অবশ্য ভাগ আছে। যেমন পাকিস্তানের প্রদেশ হলো চারটি। এগুলো হলো সিন্ধু, পাঞ্জাব, বেলুচিস্তান ও খাইবার পাখতুনখাওয়া। এর বাইরে আছে রাজধানী এলাকা ইসলামাবাদ। অরেকটি এলাকা হল এফএটিএ। যেটিকে বলা হয় ফেডারেলি অ্যাডমিনিস্ট্রার্ড ট্রাইবাল এরিয়া।

আরও পড়ুন: ইমরানের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন ১৭ অক্টোবর...

এখানে প্রতিটি প্রদেশ থেকে ২৩ জন সিনেটর রয়েছেন। আর ইসলামাবাদের চারজন এবং এফএটিএর আটজন।

এই দুটি কক্ষের সমন্বয়ে পাকিস্তান সরকার পরিচালিত হয়। কিন্তু সরকার গঠনে মুখ্য ভূমিকা পালন করে থাকে নিম্নকক্ষ ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি। কারণ, ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির সদস্যরাই প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন করে থাকেন।

২০১৮ সালের নির্বাচনেও ঠিক তা–ই হয়েছে। ওই নির্বাচনে ইমরানের দল সবচেয়ে বেশি আসন পেয়েছিল। কিন্তু সেই আসনসংখ্যা ছিল ১১৫টি। আর সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজন ছিল ১৩৭টি আসন। ফলে ছোট ছোট কয়েকটি দল এবং স্বতন্ত্র জয়ী প্রার্থীদের সঙ্গে জোট করে ক্ষমতায় এসেছিলেন ইমরান খান।


তবে সেখানে ইমরান খানের দলের মধ্যে হয়ে গিয়েছিলো এক ধরণের কোন্দল। ছিলোনা কোনো একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা। আর একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকলে যা হয়, ঠিক তা–ই হয়েছে।

২০২২ সালে এসে ইমরান খানের সরকার নড়বড়ে হয়ে যায়। ওই বছরই জোটসঙ্গীরা তাঁর বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। ফলে পার্লামেন্টে আস্থা ভোটে হেরে ইমরান খান বিদায় হন।

কিন্তু আপনি কি জানেন কে ইমরানের এই বিদায়ঘণ্টা বাজাল? এ প্রশ্নের উত্তর জানতে আমাদের আরেকটি বিষয়ে নজর দিতে হয়। পাকিস্তানের রাজনীতিতে একটি শব্দ প্রচলিত আছে। সেটি হলো ‘স্ট্যাবলিশমেন্ট’। এই স্ট্যাবলিশমেন্ট পাকিস্তানের ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। আর স্ট্যাবলিশমেন্ট বলতে মূলত দেশটির সামরিক বাহিনীকে বোঝানো হয়। যদিও স্ট্যাবলিশমেন্টের সঙ্গে দেশটির সুপ্রিম কোর্ট, বড় বড় ব্যবসায়ীর নাম জড়িয়ে আছে, তবে মুখ্য ভূমিকায় আসলে সামরিক বাহিনী।

আরও পড়ুন: আল-আকসা মসজিদ মুসলিমদের কাছে কেন এতো গুরুত্বপূর্ণ?...

এর প্রমাণও পাওয়া যায়। ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর হেরে যাওয়া সব দল সেনাবাহিনীর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল। কিন্তু ইমরান খান একটা কথাও বলেননি। বরং ‘সুষ্ঠু নির্বাচনে’ দায়িত্ব পালনের জন্য নিরাপত্তা বাহিনীকে সেই সময় ধন্যবাদ দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু সেই অবস্থানই বদলে গেল সময়ের ব্যবধানে।

২০২২ সালে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ইমরান খান আঙুল তোলেন সেনাবাহিনীর দিকে। একটা সময় দাবি করেন, তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করার পেছনে ছিলেন তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল কামার জাভেদ বাজওয়া।


এ ছাড়া ক্ষমতা ছাড়ার পরপরই ইমরান খান বলেছিলেন, পাকিস্তানের রাজনীতিতে সেনাপ্রধানই সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি। সবাই সেনাপ্রধানের সিদ্ধান্ত মেনে চলেন। সেই সময় তাঁর অভিযোগ ছিল, তিনি যাতে ক্ষমতায় ফিরতে না পারেন, তাই সেনাবাহিনী দেশটির ‘দুর্নীতিগ্রস্ত মাফিয়াদের’ পক্ষ নিয়েছে।

ক্ষমতা ছাড়ার পর বসে থাকেননি ইমরান খান, নেমেছিলেন আন্দোলনে। কিন্তু গত বছরের নভেম্বরে আন্দোলনে নেমে গুলি খান তিনি। পায়ে গুলি লাগে তাঁর। এরপর আরও ক্ষেপে যান তিনি। এবার আরও কড়া ভাষায় আক্রমণ শুরু করেন সেনাবাহিনীকে।


সম্প্রতি এমন কথা ইমরান খান বারবার বলেছেন। আর এসব কথার পরিপ্রেক্ষিতেই ইমরান খানকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল কি না, সেটা একটা প্রশ্ন। কারণ, ৮ মে রাতে ইমরান খানের এসব বক্তব্যে প্রতিবাদ জানায় পাকিস্তানের সেনাবাহিনী। কড়া ভাষায় ইমরানের সমালোচনা করে তারা। এর ২৪ ঘণ্টা না পেরোতে ৯ মে ইমরান খানকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিলো।


গত বছর পিটিআইয়ের নেতৃত্বাধীন জোটে ফাটল ধরলে আস্থা ভোটে হেরে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন ইমরান খান। এর পর থেকেই তাঁর বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা হচ্ছিল। তাঁর বিরুদ্ধে করা দুর্নীতি মামলা শতাধিক। এসব মামলার অধিকাংশই এমনভাবে করা যে তাঁর সাজা হলে তিনি আগামী নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না।

আরও পড়ুন: 'ইমরান খানকে বিষপ্রয়োগ করা হতে পারে': বুশরা বিবি...

এদিকে ইমরান খানকে গ্রেপ্তারের পর সেনানিবাসে হামলা চালিয়েছিলেন তাঁর সমর্থকেরা। এর কঠোর সমালোচনা করেছে সেনাবাহিনী। হামলাকারীদের বিচারের আওতায় আনার কথাও বলেছে সেনাবাহিনী।

এদিকে চলতি বছরের ৫ আগস্ট তোশাখানা দুর্নীতি মামলায় দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় ৩ বছরের কারাদণ্ড ও রাজনৈতিক সকল কর্মকান্ড থেকে ৫ বছরের নিষিদ্ধ হন পিটিআই চেয়ারম্যান ইমরান খান। পরে উচ্চ আদালতে তার সাজা স্থগিত হয়ে যায়।


কিন্তু রাষ্ট্রীয় গোপন নথি ফাঁস বা সাইফার মামলায় এখনো জেলে আছেন ইমরান খান। এর মধ্যে তার বিরুদ্ধে নতুন আরো কয়েকটি অভিযোগ আনা হয়েছে।

উল্লেখ্য, ইমরান খানকে পাকিস্তানের পাঞ্জাবের ‘কুখ্যাত’ অ্যাটক কারাগার থেকে রাওয়ালপিন্ডির আদিয়ালা কারাগারে স্থানান্তর করা হয়েছে।

এদিকে তাঁর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। আর সবকিছু ছাপিয়ে বড় প্রশ্নটা হচ্ছে, অস্থিতিশীল পরিস্থিতি থেকে কবে মুক্তি মিলবে পাকিস্তানের মানুষের?

অনলাইন ডেস্ক